২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ভ্রমণ ও সেখানকার উইকি সম্প্রদায়ের সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টি যখন সৃত্মিচারণ করছি তখন প্রথমেই আমার যে জিনিসগুলো মনে পড়ছে — মুখভরা হাসি, কৌতুহল এবং দারুণ আতিথেয়তা।
ব্যক্তিগত ভ্রমণের সাথে আমার কাজকে সমন্বয় করে আমি আমার স্বামীকে নিয়ে প্রায় চার সপ্তাহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ঘুরেছি এবং বাংলাদেশের উইমিডিয়ানদের সাথে পরিচিত হয়েছি। সুবিধাজনক সময়ের ব্যবধানে রাজধানী শহর ঢাকা, বন্দর নগরী নগরী চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকিপিডিয়া ও অনুষ্ঠান নিরাপত্তা সম্পর্কিত ৩টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালাগুলোর মাঝের সময়ে আমি দেশটি ঘুরে এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছি, সমস্যাগুলো দেখেছি এবং বিশেষ করে স্থানীয় উইমিডিয়ানদের সাথে কথা বলে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
বিশেষ করে নাহিদ সুলতান, মহীন রীয়াদ এবং মাসুম-আল-হাসান যারা আমাকে সাহায্য করেছিল। তারা জিনিসগুলো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল এবং তাদের মধ্যে কমপক্ষে একজন বা আরও অনেকে প্রতিদিনই আমাদের সাথে ছিল, আমাদের নিয়ে ঘুরেছে, মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, খাওয়ার সবচেয়ে ভালো জায়গাগুলোতে নিয়ে গিয়েছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেখিয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, কে বিভিন্ন বিল পরিশোধ করবে এটা নিয়ে তাদের সাথে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে — বাংলাদেশিরা তাদের অতিথিদের আপ্যায়ন করতে পছন্দ করেন, এবং তারা সবকিছুর বিল পরিশোধ করেন। আপনি বিল পরিশোধ করতে চাইলে আগে থেকে আপনাকে এ ব্যাপারে সতর্ক এবং চালাক হতে হবে!
আমরা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে (পুনরায়) শিখেছি যে, টাকা খরচ হওয়াই কোন আড্ডার, একসাথে কোন রেস্টুরেন্টে বসা, একসাথে নৌকাভ্রমণ কারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একসাথে সময় কাটানো এবং নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়। এই শিক্ষাটি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ!
এবং তারা আমাদের অনেক বিস্ময়কর জিনিস দেখিয়েছিল! একসাথে আমরা জাদুঘর এবং চিত্তাকর্ষক স্থাপত্যে গিয়েছিলাম, তারা আমাদের জন্য তাদের শহরগুলোর সৌম্য (কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ব্যাপকভাবে দূষিত) নদীগুলোতে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিল (তারা দ্রুতই জানতে পেরেছিল যে, আমি নৌকাভ্রমণ ভালোবাসি), সমুদ্র পাড়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং বিখ্যাত খাবার, স্ট্রীটফুড ও সুভ্যানিয়ার কেনার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিল। আমরা চমৎকার গোলাপী মুঘল প্রসাদ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ (বাগানযুক্ত চমৎকার একটি আধুনিক সৌধ) দেখেছি; কবি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিল্পীসহ অসংখ্য উইকিমিডিয়ানদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। এছাড়াও আমরা ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর পানামনগর, পুঠিয়া মন্দির কমপ্লেক্সসহ আরও অসংখ্য স্থান ভ্রমণ করেছি। সবসময় উপরের তিনজন আমাদের অন্যান্য উইকিমিডিয়ানদের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করেছে।
৩টি কর্মশালাতেই অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল অনেক। অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকার কর্মশালার অংশগ্রহণকারীরা নিয়মিত উইকিমিডিয়ান ছিলেন, এই অনুষ্ঠানে একইসাথে দুটি বড় ছবি প্রতিযোগিতা ডব্লিউএলএম ও ডব্লিউএলই এর পুরস্কার বিতরণ করা হয়। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর কর্মশালা দুটিতে পুরাতনদের পাশাপাশি অনেক নতুন অংশগ্রহণকারীই যোগদান করেছিল যারা পূর্বে কখনো উইকিমিডিয়া প্রকল্পে অবদান রাখেননি।
তবে, অামি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি অংশগ্রহণকারীরা যেভাবে অধীর আগ্রহে ও মনোযোগ দিয়ে কর্মশালাটি শুনেছে, তাদের সংখ্যা দেখে নয়। রাজশাহীর অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী এবং কর্মশালার পূর্বেই তারা সারাদিন ক্লাস করেছেন ও সন্ধ্যায় কর্মশালাতে অংশ নিয়েছেন।
যদিও অনেকক্ষেত্রে আমার মত বিদেশীর কাছে প্রশ্ন করা অনেক সাহসের ব্যাপার ছিল তবুও অংশগ্রহণকারীরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন — উদাহরণস্বরুপ, নারীরা উইকিমিডিয়াতে কিভাবে নিরাপদ থাকতে পারে, অথবা কিভাবে অনুবাদ উইকিমিডিয়া প্রকল্পকে সাহায্য করতে পারে।
এসব অনুষ্ঠানের মাঝে আমরা আরও জেনেছি বাংলাদেশের উইকিমিডিয়ানরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন। ঢাকা থাকাবস্থায় এবং ঢাকার কর্মশালায় যাওয়ার পথে আমরা ট্রাফিক জ্যামের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। ট্রাফিক জ্যাম ঢাকার একটি মারাত্বক সমস্যা এবং অল্প দূরুত্বে যাতায়াতেও মাঝে মাঝে অনেক সময় ব্যয় হয়। এর সাথে সেখানে অন্যান্য অনেক ছোট জিনিস যেগুলোর কারণে অনেক সময় ও শক্তি ব্যয় হয় যা আমি, একজন, ইউরোপীয় হিসেবে অভ্যস্থ না। উদাহরণস্বরুপ, কেনাকাটা অথবা রাস্তা পারাপার। একইসাথে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলই বিদ্যুৎ চলে যাওয়া সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং সব স্থানে ইন্টারনেট সহজলভ্য নয়।
এছাড়াও, আমরা জেনেছি যে, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করাকে সাধারণ মানুষ খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না। ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার ঠিক উল্টো, এখানে অবিভাবক, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্যরা এটিকে অ-কাজ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এটা জানার পর, আমার মনে হয়েছে, যদি আমি আরাম ও মজা করার জন্য খুব কম সময় পেতাম এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে উইকিপিডিয়াতে অবদানের জন্য সাধুবাদ না পেতাম — তখনও কি আমি আমার অবসর সময়ে উইকিপিডিয়া এবং এর সহপ্রকল্পগুলোতে অবদান রাখতাম?
প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রনিক পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য অন্য একটি সমস্যা যা বাংলাদেশি উইকিমিডিয়ানরা সম্মুখীন হন। যদিও জীবনধারণের খরচ এখানে বেশ কম কিন্তু অনেক সময় কম মজুরি পেয়েও ইলেক্ট্রনিক পণ্যের মূল্য তাদের অন্যান্য দেশের মত একইরকম পরিশোধ করতে হয় অথবা এটি অনেক সময় এগুলোর উপর ধার্য কর-এর কারণেও। উদাহরণস্বরুপ, অধিকাংশ মানুষের কাছেই ক্যামেরা নেই — এবং এর জন্য তারা নিজেদেরকে স্মার্টফোনে ছবি ধারণে দক্ষ করে গড়ে তুলেছে। এমন দক্ষ যে, সে ছবিগুলো ডব্লিউএলএম ছবি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্মার্টফোন ব্যবহারও কিছুটা বিলাসিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং আমি শুনেছি, এমন অনেক উইকিমিডিয়ান আছেন যার সাধারণ মোবাইল থেকেও উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখেন। শুধু কল্পনা করুন, ভালো উপকরণ পেলে সেসব উইকিপিডিয়ানরা কি করবেন!
এবং সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বাংলাদেশের উইকিমিডিয়ানরা অনেক সক্রিয়। যদিও অনেক বেশি নয়, আমি জেনেছি, ১০০ থেকে ২০০-এর মধ্যে হবে। তাদের সাথে নিয়ে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ চ্যাপ্টার — যা ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত — স্টুয়ার্ড, অ্যাফকম সদস্য এবং উইকিমিডিয়া কমন্সের প্রশাসক হিসেবে উইকিমিডিয়ার বৈশ্বিক সম্প্রদায়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। অনেক বেশি না হলেও তারা অনেক চমৎকার অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে বছরব্যাপী — তারা উদ্দীপনার সহিত ‘উইকিলাভ’ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আপনি যদি উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান এবং এই দেশের চমৎকার সব অবদানকারী সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে চান, আপনি নিজেই তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন! সত্যিই, আপনার চমৎকার অভিজ্ঞতা হবে!
ক্রিৎজোলিনা,
জার্মান উইকিমিডিয়ান
Read this post in English language