ইউক্রেনের একটি নেচার রিজার্ভে ধারণ করা ক্রাসনিককাজা ক্যাটের এই ছবিটি ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম স্থান লাভ করে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স/সিসি-বাই-এসএ ৪.০
উইকি লাভস আর্থ (ডব্লিউএলই) বার্ষিক আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা, যা বছরের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাপী আয়োজিত হয়। এই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য বিশ্বের সংরক্ষিত অঞ্চলসমূহের আলোকচিত্রের স্থায়ী সংগ্রহশালা তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষার উইকিমিডিয়া প্রকল্পসমূহে (যেমন, উইকিপিডিয়া, উইকিভ্রমণ) ছবিগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ঠ অঞ্চলসমূহকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা।
প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণকারীরা স্থানীয় প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ছবি ধারণ করে মুক্ত লাসেন্সের অধীনে উইপিডিয়ার সহ-প্রকল্প উকিমিডিয়া কমন্সে আপলোড করে। মুক্ত লাইসেন্সের সুবিধা হল, পরবর্তীতে যে কেউ এসকল ছবি আলোকচিত্রীকে স্বীকৃতিপদান করে অনত্র ব্যবহার করতে পারবে।
স্থানীয় উইকিমিডিয়া অধ্যায় (চ্যাপ্টার), উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। চলতি বছর সর্বাধিক - রেকর্ডসংখ্যক ৩৭টি দেশে ১ মে থেকে ৩০ জুনের মধ্যে স্থানীয়ভাবে মাসব্যাপী এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হচ্ছে।
অংশগ্রহণকারী যে কোনো দেশের তালিকাভূক্ত সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও এর জীববৈচিত্র্যের একাধিক ছবি যে কেউ প্রতিযোগিতায় জমা দিতে পারেন। প্রতিযোগিতায় স্থানীয় (দেশ ভিত্তিক) এবং আন্তর্জাতিক, দুইটি পর্যায়ে সেরা আলোকচিত্র নির্বাচন করা হয়। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহকারী প্রতিটি দেশ তাদের স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত সেরা ১০টি আলোকচিত্র আন্তর্জাতিক জুরিদের নিকট প্রস্তাব করে। প্রতিটি দেশের ছবি থেকে সেরা ১৫টি আলোকচিত্র আন্তর্জাতিকভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিকভাবে তৃতীয় হয়েছিল আব্দুল মোমিনের তোলা সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের এই ছবিটি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স/সিসি-বাই-এসএ ৪.০
চলতি বছর আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম বিজয়ী আলোকচিত্রীকে ২০২০ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় উইকিপিডিয়ার বার্ষিক সম্মেলন ‘উইকিম্যানিয়া’য় যোগদানের সুযোগ অথবা সমমূল্যের অ্যামাজন ভাউচার প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ স্থানীয় পর্যায়ে বিজয়ীদের জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার ও সনদ।
২০১৩ সালে ইউক্রেনে প্রথম ইয়েভেন বুকেটের নেতৃত্বে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে প্রতিযোগিতাটি শুরু হয়। সে বছর ৩৪৬ জন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং ৯,৬৯৫ আলোকচিত্র জমা পরে। প্রথমবারের মতো আয়োজিত প্রতিযোগিতাটি ২০১৩ সালের উইকিমিডিয়ার বার্ষিক সম্মেলন উইকিম্যানিয়ায় ‘দ্বিতীয় কুলেস্ট প্রকল্প’ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।
প্রাথমিক সাফল্যের পর, পরবর্তী বছর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আঞ্চলিক উইকিপিডিয়া স্বেচ্ছাসেবক কর্তৃক এটি আয়োজিত হচ্ছে। ২০১৪ সালে সর্বপ্রথম ইউরোপের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকায় উইকি লাভস আর্থ বিস্তার লাভ করে। সে বছর এই প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় সংস্করণে ১৬টি দেশ থেকে ৩ হাজারের অধিক অংশগ্রহণকারীর ৭০ হাজারের অধিক আলোকচিত্র জমা পরে।
রাশিয়ার একাতেরিনা ভাসেজিনার তোলা সাখালিন দ্বীপের এই ছবি ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম স্থান লাভ করে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স/সিসি-বাই-এসএ ৪.০
২০১৫ সালে ২৬টি দেশে প্রতিযোগিতার তৃতীয় সংস্করণ আয়োজিত হয়। সে বছর ৮ হাজারের অধিক অংশগ্রহকারী তাদের ১ লক্ষের অধিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় জমা দেয়।
২০১৬ সালে প্রতিযোগিতার তৃতীয় সংস্করণ ভৌগলিকভাবে আরো বিস্তৃতি পায়। সে বছরই প্রথমবারের মতো তালিকাভুক্ত অংশগ্রহণকারী দেশের বাইরে ইউনেস্কোর সহযোগিতায় নতুন মনোনীত স্থানের তালিকা যোগ করা হয়। যেখানে ১২০টি দেশে ইউনেস্কো জৈবমণ্ডল (বায়োস্ফিয়ার) সংরক্ষণের ছবি আপলোড করার জন্য অংশগ্রহণকারীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সে বছর ১৩ হাজারের অধিক অংশগ্রহণকারী তাদের ১ লক্ষ ১৫ হাজারের অধিক আলোকচিত্র জমা দেয়।
২০১৭ সালে ৩৬টি দেশ স্থানীয়ভাবে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। যেখানে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, নরওয়ে সহ অন্যান্য দেশ অংশ নেয়। প্রতিযোগিতায় ১৫,২৯৯ জন অংশগ্রহকারী কর্তৃক সর্বমোট ১,৩১,৯৪৮ আলোকচিত্র জমা পড়ে। যাদের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার অংশগ্রহণকারী প্রথমবারের মতো উইকিপিডিয়ার ছবি আপলোড করেছিলেন।
বিগত বছর, ২০১৮ সালে ৩২টি দেশের ৭,৬৪৫ জন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং ৯০ হাজারের অধিক আলোকচিত্র জমা করে। দেশ অনুযায়ী তালিকাভুক্ত স্থানসমূহের পাশাপাশি ইউনেস্কো জৈবমণ্ডল সংরক্ষণের এবং বিশ্ব জুড়ে ইউনেস্কো বৈশ্বিক ভৌগলিক উদ্যানের জন্য আলাদা তালিকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। গত ৬ বছরে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় ৫ লক্ষের অধিক ছবি সংগৃহিত হয়েছে, যা অন্যান্য আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার তুলনায় ব্যাপক।
২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ নিয়মিত এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের আঞ্চলিক চ্যাপ্টার উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে প্রতিবছর মে মাসে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তবে চলতি বছর ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে মে মাসের পরিবর্তে জুন মাসে প্রতিযোগিতাটি আয়োজিত হচ্ছে।
২০১৭ সালে আয়োজিত প্রতিযোগিতার বাংলাদেশের সংস্করণে ১৯২ জন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং ১,৩৩৯ আলোকচিত্র জমা পডে। পরবর্তী বছর ২০১৮ সালে অংশগ্রহণকারী এবং ছবির সংখ্যা তুলনামূলক বৃদ্ধি পায়, এবং ৩৮১ জন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় যেখানে ২,৭৯৭ আলোকচিত্র জমা পরেছিল।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে স্থানীয়ভাবে জমা দেওয়া ১০টি ছবির মধ্যে তিনটি ছবি আন্তর্জাতিক বিজয়ী তালিকায় ৩য়, ৮ম ও ১২তম স্থান দখল করে। প্রতিযোগিতার সমন্বয়ক ও উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নাহিদ সুলতান বলেন, ‘দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার আন্তর্জাতিক এই মঞ্চে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।’ একইসাথে প্রতিযোগিতাটি দেশের পর্যটনখাতে বিদেশী পর্যটক আকৃষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত স্থানের মধ্যে রয়েছে সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান, সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং অন্যান্য সংরক্ষিত অঞ্চল, যার মধ্যে রয়েছে দেশের গুরত্বপূর্ণ উদ্ভিদ উদ্যান, ইকোপার্ক এবং জলাবন।
উইকি লাভস আর্থ বিশ্বের গুরত্বপূর্ণ ও বৃহৎ আলোকচিত্র প্রতিযোগিতাগুলোর একটি এবং এতে আন্তর্জাতিক স্কীকৃতি অর্জনের সুযোগ থাকা স্বত্বেও অন্যান্য আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার তুলনায় বাংলাদেশে এই প্রতিযোগিতায় পেশাদার আলোকচিত্রীদের অংশগ্রহণ খুবই কম। আশাকরি, ভবিষ্যতে আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন।
মহীন রীয়াদ,
উইকি লাভস আর্থ আঞ্চলিক সমন্বয়ক ও উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের নির্বাহী সদস্য